আকাশ সংস্কৃতি

(সংকেত: ভূমিকা; আকাশ সংস্কৃতি কি; আকাশ সংস্কৃতির উদ্ভব; আকাশ সংস্কৃতির বিকাশ; আকাশ সংস্কৃতির ইতিবাচক দিক; আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক দিক; বাংলাদেশ ও আকাশ সংস্কৃতি; বিশ্ব ও আকাশ সংস্কৃতি; আমাদের করণীয়; উপসংহার।)

ভূমিকা: সংস্কৃতি একটি জাতি ও রাষ্ট্রের দর্পণস্বরূপ। প্রতিটি জাতি ও সমাজেরই আলাদা সংস্কৃতি থাকে। এই সংস্কৃতির মাধ্যমেই একটি জাতি ও রাষ্ট্র বিশ্বের দরবারে তাদের গৌরব ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে পারে। কিন্তু আধুনিককালে বিশ্বায়নের কারণে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে। সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ও আকাশ সংস্কৃতির ব্যাপকতায় পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতির আদান-প্রদানও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বায়নের যুগে এসে বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইসের সুবাদে আকাশ সংস্কৃতি নামে অনুন্নত দেশের সংস্কৃতিকে গ্রাস করছে উন্নত দেশগুলোর সংস্কৃতি। ফলশ্রুতিতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো তাদের সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা হারাচ্ছে।

আকাশ সংস্কৃতি কি: মানুষের জীবনাচরণই তার সংস্কৃতি। ডিজিটাল ডিভাইস, স্যাটেলাইট তথা ডিশ এন্টেনার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানই হলো আকাশ সংস্কৃতি। স্যাটেলাইট ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে আকাশ সংস্কৃতির বিস্তারে আমাদের তরুণ ও যুব সমাজের মাঝে দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি যেমন অনীহা বাড়ছে তেমনি বিদেশি সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের সর্বনাশা প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। এভাবে আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।

আকাশ সংস্কৃতির উদ্ভব: কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের অনুষ্ঠান সম্প্রচার হয়। এর মাধ্যমে আমরা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান গ্রাহক যন্ত্রের মাধ্যমে সরাসরি উপভোগ করতে পাচ্ছি। আর এভাবেই উদ্ভব ঘটেছে আকাশ সংস্কৃতির। আমরা টেলিভিশন ও রেডিওতে আবহাওয়াসহ বিভিন্ন খবর দেখি ও শুনি এগুলো মূলত সম্ভব হয়েছে স্যাটেলাইট এর মাধ্যমে যেটিকে আমরা আকাশ সংস্কৃতি বলি। আকাশ সংস্কৃতির মাধ্যমেই একটি দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে অন্য দেশ সম্যক ধারণা পাচ্ছে।

আকাশ সংস্কৃতির বিকাশ: স্যাটেলাইট প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের দেশের মানুষ আজ দেশি বিদেশি নানামুখী চ্যানেল ও ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছে। আগে যেখানে বাংলাদেশে বিটিভি-ই ছিল একমাত্র ইলেকট্রনিক বিনোদনের মাধ্যম সেখানে স্যাটেলাইটের সুবাদে এখন বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি মোট ৪১টি টিভি চ্যানেল চালু রয়েছে। যার মধ্যে ৩টি সরকারি ও বাকীগুলো বেসরকারি । এর মধ্যে এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই, আরটিভি, এনটিভি, বৈশাখী, বাংলাভিশন, যমুনা টিভি, মাছরাঙা, দেশ টিভি, সময়, ইনডিপেন্ডেন্ট ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।২০০৪ সালে অশ্লীলতার বিবেচনায় সরকার এটিভি, টিভি-৬, চ্যানেল-ভিসহ বেশ কটি চ্যানেলের অনুষ্ঠান প্রচারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও এমটিভি, সনিটিভি, জিটিভি, এইচবিও, স্টার মুভি, ইটিসি, বিফোরইউসহ আরও অনেক মিউজিক ও মুভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান শহর থেকে শুরু গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত ঘরে ঘরে প্রচারিত হচ্ছে। তাছাড়া বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরা ইত্যাদি চ্যানেলগুলোতে আন্তর্জাতিক সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে। পাশাপাশি ডিসকভারি, এনিমেল প্লানেট, অ্যাডভেঞ্চারার্সসহ বেশ কিছু চ্যানেল আছে যেগুলো পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা প্রকৃতির আশ্চর্য সৃষ্টিকে দর্শকের সামনে তুলে ধরছে। এভাবে প্রতিনিয়ত আকাশ সংস্কৃতির বিস্তার ঘটছে।

আকাশ সংস্কৃতির ইতিবাচক দিক: বর্তমান আধুনিক বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রেই প্রতিটি দেশ একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বর্তমান বিশ্বে তথ্য ব্যবস্থার যে অবাধ প্রবাহ তার সাথে নিজেদেরকে সংযুক্ত রাখতে হলে ইন্টারনেট ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। স্যাটেলাইট আবিষ্কারের মাধ্যমে বিশ্ব একটি Global Village এ পরিণত হয়েছে। এই Global Village-এর সদস্য হয়ে এ থেকে সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা হাসিলের জন্য আমাদেরকে তথ্য প্রযুক্তিতে আরো বেশি অগ্রগামী হতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজার ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সংবাদ জানতে হলে বিবিসি, সিএনএনসহ আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থাগুলোর সাথে যোগাযোগ না থাকলে আমরা জাতি হিসেবে পিছিয়ে পড়বো। এছাড়া ইন্টারনেট প্রচলনের মাধ্যমে আমরা যে মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেছি এর মাধ্যমে আমাদের চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটেছে। এটি আমাদেরকে বিভিন্ন সংকীর্ণ ধ্যান-ধারণার পরিবর্তে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চিন্তা করার সুযোগ করে দিচ্ছে। দেশ বিদেশের বিভিন্ন চ্যানেলে অবাধ প্রবেশের মাধ্যমে আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের রাজ্যে সহজভাবে বিচরণ করতে পারছি। যেটি আমাদের জাতিগঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।

আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক দিক: বাংলাদেশে আকাশ সংস্কৃতির ইতিবাচক দিক অপেক্ষা নেতিবাচক দিকই বেশি। আকাশ সংস্কৃতির করাল গ্রাসে আজ আমাদের সমাজ কাঠামো ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গঠন প্রকৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের পরিবারের বন্ধন নষ্ট হচ্ছে। পশ্চিমা সমাজের বিবাহবন্ধনহীন অনৈতিক জীবনব্যবস্থা আমাদের দেশের জনগণকে প্রভাবিত করছে। ফলশ্রুতিতে চরম সামাজিক অবক্ষয় দেখা দিচ্ছে। আমরা সমাজে লক্ষ করছি বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। আকাশ সংস্কৃতির স্রোতে আমাদের তরুণ ও যুব সমাজ বিপথগামী ও রুচিহীন হয়ে পড়ছে।আকাশ সংস্কৃতির মাধ্যমে বিদেশি সংস্কৃতির ব্যাপক আগ্রাসনের ফলে আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ ও খাদ্যাভাসে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তাছাড়া এটি আমাদের জীবনবোধ, নৈতিক শিক্ষা ও ধর্মীয় অনুভূতিতে ব্যাপক আঘাত হানছে। ফলশ্রুতিতে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার ফলে সমাজে অন্যায়-অবিচার যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি জটিল রোগের সৃষ্টি হচ্ছে।

বাংলাদেশ ও আকাশ সংস্কৃতি: বাংলাদেশে বিদেশি চ্যানেলগুলো অবাধে তাদের অনুষ্ঠানাদি সম্প্রচার করে যাচ্ছে। ফলে ইউরোপীয় চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে প্রচারিত অনুষ্ঠানের কারণে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন নষ্ট হচ্ছে। পশ্চিমা ভোগবাদী সংস্কৃতির ব্যাপক প্রচারের ফলে আমাদের ধর্মনিষ্ঠা, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ পরাস্থ হচ্ছে। অপরদিকে ভারতীয় চ্যানেলগুলোও বিভিন্ন প্রকার অনুষ্ঠান ও সিরিয়াল প্রচারের মাধ্যমে আমাদের দেশের নারী সমাজকে পারিবারিক কোন্দলের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হচ্ছে পারিবারিক বিরোধ। এভাবে আমাদের পরিবার ও সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে।

বিশ্ব ও আকাশ সংস্কৃতি: আকাশ সংস্কৃতির মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অপরদিকে উন্নত দেশগুলো স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তাদের সাংস্কৃতিক ধ্যান-ধারণা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর দুর্বল সংস্কৃতি পাশ্চাত্যের তথাকথিত উন্নত সংস্কৃতির আগ্রাসনে ব্যাপক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের মত অনুন্নত দেশগুলোর নিজস্ব সংস্কৃতি বিলুপ্ত হচ্ছে। উন্নত দেশগুলো তাদের সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে অনুন্নত দেশগুলোকে শাসন করছে।

আমাদের করণীয়: বর্তমানে গোটা পৃথিবী একটি বিশ্ব গ্রামে পরিণত হয়েছে। সুতরাং এই পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে এই বিশ্ব গ্রামের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। সেজন্য এই ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও স্বার্থকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা করতে হবে। বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন হতে নিজস্ব সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে হলে আমাদেরকে বিদেশি সংস্কৃতির ইতিবাচক দিকগুলো গ্রহণ করতে হবে এবং নেতিবাচক দিকগুলো বর্জন করতে হবে। সে জন্য বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমাদেরকে আরও বেশি দক্ষতা অর্জন করতে হবে। দেশীয় সংস্কৃতির লালন আর বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হলে দেশীয় সংস্কৃতিকে আরও যুগোপযোগী করে তুলতে হবে। বর্তমানে চালু আমাদের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর সম্প্রচারে আরও বৈচিত্র্য আনয়নের পাশাপাশি নতুন নতুন স্যাটেলাইট চ্যানেল চালুর পদক্ষেপ নিতে হবে।

উপসংহার: আকাশ সংস্কৃতির করালগ্রাসে বর্তমানে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো নাজেহাল। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের ফলে অনুন্নত দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সেজন্য আমাদেরকে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এর পাশাপাশি যে সকল স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি প্রচার করছে সেগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে অথবা ঐ সকল চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার নিষিদ্ধ করতে হবে।

স্বনির্ভর বাংলাদেশ

(সংকেত: ভূমিকা; স্বনির্ভরতা কি; স্বনির্ভরতার পথে হাঁটছে বাংলাদেশ; স্বনির্ভরতার পথে অন্তরায়সমূহ; স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে করণীয়; সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ; উপসংহার।)

ভূমিকা:
সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা
সোনা নয় তত খাঁটি।
বল যত খাঁটি তার চেয়ে খাঁটি আমার বাংলাদেশের মাটি
ও ভাই আমার জন্মভূমির মাটি।
-আব্দুল লতিফ


দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটি দেশ বাংলাদেশ। সত্যিই বাংলাদেশ এক অপার সম্ভাবনার দেশ। এদেশের মাটিতে সবখানেই সোনা ফলে। সেকালের চিরায়ত বুলি এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে-গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু। এ নিয়েই সুখী ছিল এদেশের বাঙালি পরিবার। কিন্তু সেই সমৃদ্ধকাল পৌনে দুশ বছরের ইংরেজ শাসন ও চব্বিশ বছরের পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের কারণে বিপন্ন হয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সকল পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। অতীতের সকল গ্লানি মুছে বাংলাদেশ আজ নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। স্বনির্ভর দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা চলছে।

স্বনির্ভরতা কি: ইংরেজি Self Dependent শব্দের বাংলা পরিভাষা হলো স্বনির্ভরতা। স্বনির্ভরতা বলতে অন্য কারও সাহায্যের উপর নির্ভর না করাকে বুঝায়। অর্থনৈতিকভাবে বলতে গেলে- নিজ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে পরনির্ভরশীলতা হ্রাস করাই স্বনির্ভরতা।

স্বনির্ভরতার পথে হাঁটছে বাংলাদেশ: ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন হয় এদেশ। স্বাধীনতা যুদ্ধে সারাদেশ প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। বিভিন্ন চড়াই উৎরাই পেরিয়ে নব্বই দশকে গণতন্ত্রের যাত্রার সাথে সাথেই স্বনির্ভরতা অর্জনের পথচলা শুরু হয়। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, একদিকে দেশে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের পরিমাণ কিছুটা কমেছে, অন্যদিকে ঋণ পরিশোধের মাত্রা বেড়েছে। ১৯৯০ সালে বৈদেশিক ঋণ সাহায্যের পরিমাণ ছিল ১৮১ কোটি মার্কিন ডলার এবং পরিশোধিত হয়েছে ৩০ দশমিক ২ কোটি মার্কিন ডলার। আর ২০০৯ সালে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১৭২ দশমিক ৭ এবং পরিশোধ হয়েছে ৮২ দশমিক ৩ মার্কিন ডলার।

কৃষি উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে খাদ্য শস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৭৭ দশমিক ৮৭ লক্ষ মেট্রিক টন। আর ২০১২-১৩ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৩৭৫.০৮ লক্ষ মেট্রিক টন। এর ফলে খাদ্যশস্যে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে চলেছে। দেশে বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ। বর্তমানে ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রিজার্ভ রয়েছে যা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়েছে। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বর্তমানে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১১৯০ মার্কিন ডলার। যা ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ছিল ৫৩৩ মার্কিন ডলার। কমেছে বেকারত্ব, দারিদ্রের হার, শিশু মৃত্যুহার, মাতৃমৃত্যুহার। দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে। সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। বর্তমানে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ৩২১ কিলোওয়াট। ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে এরই মধ্যে অনেক উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ভিশন-২০২১ বাস্তবায়ন করে চলেছে সরকার। তথ্য প্রযুক্তি খাতে এসেছে অভাবনীয় সাফল্য। বর্তমানে দেশে ৯ কোটির অধিক মোবাইল ফোন গ্রাহক রয়েছে। সুতরাং বলা যায়, বাংলাদেশ অতীতের সকল বাধা বিপর্যয় উপেক্ষা করে স্বনির্ভরতার পথে এগিয়ে চলেছে।
বাংলাদেশের স্বনির্ভরতার পথে অন্তরায়/বাধাসমূহ: এককালের সমৃদ্ধ বাংলাদেশের অতীত গৌরব আজ ধূসর স্মৃতি মাত্র। ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৫শ বর্গকিলোমিটারের এ দেশের স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রধান অন্তরায়সমূহ হলো-

জনসংখ্যা সমস্যা: স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে বাংলাদেশের প্রধান অন্তরায় হলো জনসংখ্যা সমস্যা। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৩ মতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বর্তমানে ১৫ কোটি ৩৬ লাখ এবং প্রতিবর্গ কিলোমিটারে ১০১৫ জন গড়ে বাস করে। তবে বেসরকারি হিসাব মতে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটিরও অধিক যা ২০২৫ সালের মধ্যে ১৮ কোটি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য শস্য আমদানি করতে হয়। এ ছাড়া কর্মসংস্থানের সমস্যা সৃষ্টিসহ নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি করছে। যা স্বনির্ভরতা অর্জনে প্রধান অন্তরায়।

দারিদ্র্য: বাংলাদেশে ৪০ শতাংশ লোক এখনো চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। আর এ দারিদ্রতা বাংলাদেশের স্বনির্ভরতার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও জাতিসংঘ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের দারিদ্র্য সীমা ২৯ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।

বেকারত্ব: বর্তমানে বাংলাদেশে বেকারত্ব সমস্যা এখনো প্রকট। দেশে শতকরা ২৩ ভাগ লোক এখনো বেকারত্বের অভিশাপে ভুগছে আর এটিই স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে অন্যতম বাধা।

রাজনৈতিক অস্থিরতা: বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা। এর ফলে বৈদেশিক বিনিয়োগ হ্রাস পায়। হানাহানি, জ্বালাও পোড়াও রাজনীতি, ধর্মঘটে কৃষি ও শিল্পের উৎপাদন কমে যায়। ফলে স্বনির্ভরতার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হয়।

দুর্নীতি: যেকোনো দেশের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হলো দুর্নীতি। আর এই দুর্নীতি বাংলাদেশের সর্বস্তরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ঘুষ, অনিয়মে ছেঁয়ে গেছে বাংলাদেশের সকল স্তর। যা স্বনির্ভরতার পথে বাধা হিসেবে কাজ করছে।

জ্বালানি সংকট: উন্নয়ন প্রধান শর্ত হলো নিরবিচ্ছিন্ন জ্বালানি শক্তি তথা বিদ্যুৎ উৎপাদন। কিন্তু বাংলাদেশ জ্বালানি তথা বিদ্যুৎ খাতে এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনি। ফলে সময়মত সেচ সুবিধা, শিল্প উৎপাদন চরমমাত্রায় ব্যাহত হচ্ছে, যা স্বনির্ভরতার পথে প্রধান বাধা।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ: বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম দুর্যোগ প্রবণ দেশ হিসেবে স্বীকৃত। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, সাইক্লোন ইত্যাদি লেগেই আছে। জলবায়ু পরিবর্তনে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত এদেশে উপকূলীয় অঞ্চলে লোনা পানির প্রকোপ বেড়েছে অধিক পরিমাণে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়।

স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে করণীয়: বাংলাদেশ স্বনির্ভর করতে হলে যেসব পদক্ষেপ নেয়া একান্ত প্রয়োজন তা নিম্নরূপ-

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যা এবং ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। অধিক জনসংখ্যা একটি প্রধান সমস্যা। সুতরাং জনসংখ্যাকে পরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করে স্বনির্ভরতা আনতে হবে।

দারিদ্র্য দূরীকরণ: বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা হলো দারিদ্র্য সমস্যা। দারিদ্রতার নাগপাশ থেকে আমাদের মুক্তি অর্জন করতে হবে স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে।

রাজনৈতিক অস্থিরতা নিরসন: অপার সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু ঘনঘন হরতাল ও সহিংসতা এদেশে লেগেই রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য দেশের উন্নয়ন ব্যবস্থা একদমই ভেঙে পড়ার মতো অবস্থায় পৌঁছেছে। সুতরাং স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে অবশ্যই রাজনৈতিক অস্তিরতা দূর করতে হবে।

ব্যক্তিখাতের উন্নয়ন: আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি বিকাশমান ধারা। গত ৪৩ বছরে আমাদের দেশে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, কৃষক সমাজ, যুবক ও মহিলা এবং বৃহত্তর অর্থে দরিদ্র জনগোষ্ঠী একটি বিরাট বিপ্লবের ভূমিকায় অবতীর্ণ রয়েছে। ব্যক্তিখাতের এ বিকাশ ও অগ্রগতি ধরে রাখতে হবে।

তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা: দিনবদলের সনদ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে সবাইকে এক যোগে কাজ করতে হবে। এজন্য আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।

রেমিট্যান্স প্রবাহ ধরে রাখা: দেশের অর্থনীতির প্রাণ বলা হয় প্রবাসী শ্রমিকদের প্রেরিত রেমিট্যান্সকে। বাংলাদেশ রেমিট্যান্স অর্জনে বিশ্বে ৭ম স্থান অধিকার করেছে। সুতরাং স্বনির্ভর ও মজবুত বাংলাদেশ গড়তে প্রবাসী শ্রমিকদের নানা সমস্যা সমাধান করে রেমিট্যান্সের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।

সামাজিক অগ্রগতি ধরে রাখা: দেশকে স্বনির্ভর করতে হলে শিক্ষার হার, গড় আয়ু বাড়াতে হবে। এই সূচকই বলে দেবে আমাদের অবস্থান কোথায়। দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে। শিশু-মৃত্যু, মাতৃ-মৃত্যুর হ্রাস পেয়েছে। গড় আয়ু বেড়েছে। এখন দরকার এই ধারা অব্যাহত রাখা।

পোশাক শিল্পের উন্নয়ন: বাংলাদেশে প্রধান রপ্তানি আয়ের উৎস পোশাক রপ্তানি। দেশে ৫ হাজারের অধিক পোশাক কারখানা রয়েছে যেখানে ৪০ লক্ষের বেশি শ্রমিক কাজ করছে। আর দেশকে স্বনির্ভর করতে হলে এই পোশাক শিল্পের সকল অস্থিরতা দূর করে উন্নয়নের গতি অব্যাহত রাখতে হবে।

গ্রিন ব্যাংকিং ও সেবা বৃদ্ধি: বর্তমানে দেশে ইতোমধ্যে সবুজ বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে। গ্রিন ব্যাংকিং এর সেবা খাতের বিকাশ ঘটিয়ে দেশকে স্বনির্ভরতার পথে নিয়ে যেতে হবে।

সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ: বাংলাদেশের স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষত কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে সরকার অত্যন্ত তৎপর। দেশের প্রত্যেক জেলায় স্বতন্ত্রভাবে স্বনির্ভরতার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও সিলেট জেলায় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। জেলা বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। বস্তুত এ সব প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশকে স্বনির্ভর করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

উপসংহার:
‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।’
-দ্বিজেন্দ্রলাল রায়


সুজলা, সুফলা, শস্য, শ্যামলা এমন দেশটি আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর তাই স্বনির্ভরতা জীবনের সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। জাতির জীবনের দারিদ্র্য দূর করে, বিদেশি সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতার অবসান ঘটিয়ে সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলতে পারলেই স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। ব্যক্তিজীবনের কল্যাণ সাধনের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা সম্ভবপর হলে তা জাতীয় জীবনেও প্রভাব ফেলবে। আর তাই স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সকলের এক যোগে আন্তরিকভাবে কাজ করে যেতে হবে।

নেলসন ম্যান্ডেলা

শিক্ষাজীবন: স্কুল থেকে পাশ করার পর ম্যান্ডেলা ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অফ আর্টস কোর্সে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ম বর্ষের শেষে ম্যান্ডেলা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বর্ণবাদী আচরণের বিরুদ্ধে ছাত্র সংসদের ডাকা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তাই কর্তৃপক্ষ তাকে শাস্তি হিসেবে ফোর্ট হেয়ার থেকে বহিষ্কার করেন। পরবর্তীকালে জোহানেসবার্গের আইনী প্রতিষ্ঠান উইটকিন সিডেলস্কি অ্যান্ড এডেলম্যানে কেরানি হিসেবে যোগ দেন। এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সময় তিনি ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ আফ্রিকার দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের অধীনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ইউনিভার্সিটি অফ উইটওয়াটার স্ট্যান্ড থেকে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শুরু করেন। এসময়ে তিনি জোহানেসবার্গের উত্তর দিকের শহর আলেক্সান্ডিয়াতে বাস করতেন।
রাজনৈতিক জীবন: নেলসন ম্যান্ডেলা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময়ই ১৯৪৪ সালে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (এএনসি) যোগ দিয়ে যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু সিসুলু, অলিভার টাম্বার মতো তরুণ, বুদ্ধিদীপ্ত ও নিবেদিতপ্রাণ একনিষ্ঠ কর্মীদের একত্র করে এএনসিকে পুরোপুরি আন্দোলনমুখী দলে পরিণত করেন। ১৯৪৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকান নির্বাচনে বর্ণবাদে বিশ্বাসী ও বিভিন্ন জাতিকে আলাদা করার পক্ষপাতি আফ্রিকানদের দল ন্যাশনাল পার্টি জয়লাভ করে। ন্যাশনাল পার্টির ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষাপটে ম্যান্ডেলা সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। রাজনৈতিক জীবনের প্রথমভাগে নেলসন ম্যান্ডেলা মহাত্মা গান্ধীর দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হন। তিনি প্রথম থেকেই অহিংস আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন। ১৯৫২ সালে তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৫ সালে জনগণের সম্মেলনেও তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন: ১৯৫৫ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা জনগণের সম্মেলনে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মূল ভিত্তি হিসেবে ‘স্বাধীনতার সনদ’ বা ‘মুক্তি সনদ’ প্রনয়ণ করেন। ১৯৫২ সালের অসহযোগ আন্দোলনের কারণে ম্যান্ডেলাকে কমিউনিস্ট দমন আইনে অভিযুক্ত করা হয়। তার সকল প্রকার সভা-সমাবেশ ও ছয় মাস পর্যন্ত জোহানেসবার্গের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর ম্যান্ডেলা এএনসির নতুন সাংগঠনিক পরিকল্পনা তৈরি করেন এবং কৃষ্ণাঙ্গ পরিচালিত প্রথম আইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকার ১৯৫৬ সালের ৫ ডিসেম্বর ম্যান্ডেলাসহ ১৫৬ জন বর্ণবাদবিরোধী কর্মীকে দেশদ্রোহিতার মামলায় গ্রেফতার করে। সুদীর্ঘ ৫ বছর (১৯৫৬-৬১) ধরে মামলা চললে পরে সব আসামী নির্দোষ প্রমাণিত হয় এবং ১৯৬১ সালে সবাইকে মুক্তি দেয়া হয়। ঐ বছর ম্যান্ডেলা এএনসির সশস্ত্র অঙ্গসংগঠন ‘উমখান্তো উই সিমওয়ে’ অর্থাৎ ‘দেশের বল্লম’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি বর্ণবাদবিরোধী সরকার ও তার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতী ও চোরাগোপ্তা হামলার পরিকল্পনা ও সমন্বয় করেন। এতে বর্ণবাদী সরকার পিছু না হটলে প্রয়োজনবোধে গেরিলা যুদ্ধে যাবার জন্যও পরিকল্পনা করেন।

সংগ্রামী জীবন: দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা নিপীড়ন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন সফল হবে না বলে ম্যান্ডেলা সশস্ত্র আন্দোলনের পথ বেছে নিয়ে ছিলেন। বর্ণবাদভিত্তিক আন্দোলনের কারণে ১৯৬২ সালের ৫ আগস্ট ম্যান্ডেলাকে গ্রেফতার করে জোহানেসবার্গের দূর্গে আটকে রাখা হয়। ১৯৬১ সালে শ্রমিক ধর্মঘটে নেতৃত্বদান এবং বেআইনীভাবে দেশের বাইরে যাবার অভিযোগে তাকে অভিযুক্ত করা হয়। ১৯৬২ সালের ২৫ অক্টোবর এই দুই অভিযোগে তাকে ৫ বছরের কারাদ- দেয়া হয়। এর দুই বছর পর ১৯৬৪ সালের ১১ জুন ম্যান্ডেলার বিরুদ্ধে এএনসির সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্বদান এবং অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে রিভোনিয়া ট্রায়ালে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। পরে পাঠানো হয় কুখ্যাত রোবেন দ্বীপের কারাগারে।

ম্যান্ডেলার
(সংকেত: ভূমিকা; নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম ও শৈশবকাল; ম্যান্ডেলার শিক্ষাজীবন; রাজনৈতিক জীবন; বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন; সংগ্রামী জীবন; কারাজীবন; কারাগার থেকে মুক্তি; দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি; ম্যান্ডেলার অনন্য রূপ; পুরস্কার ও সম্মান; ম্যান্ডেলার অন্তিমকাল; উপসংহার।)

ভূমিকা: বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ও মহান রাষ্ট্রনায়কদের একজন হলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার জাতির পিতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি এক মহান অবিসংবাদিত নেতা ও বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রবাদ পুরুষ। তিনি বর্ণবাদ নির্মূল তথা জাতীয় ঐক্যের জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। তার অক্লান্ত সংগ্রামের ফলেই অবহেলিত ও নিপীড়িত মানুষ স্বাধীনতা, সাম্য ও মুক্তির স্বাদ পেয়েছে।

নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম ও শৈশবকাল: নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার উমতাতু প্রদেশের এমভাজো গ্রামে টেম্বু রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম হেনরি ম্যান্ডেলা, মায়ের নাম নোসেকেনি ফ্যানি। তার ডাকনাম ‘রোরিহ্লাহ্লা’ যার অর্থ ‘গাছের ডাল ভাঙে যে’ অর্থাৎ সমস্যা সৃষ্টিকারী, উপদ্রবকারী বা দুষ্টু ছেলে। দক্ষিণ আফ্রিকানদের কাছে তিনি মাদিবা নামে বেশি পরিচিত। তবে পূর্বপুরুষদের নাম অনুযায়ী তার পদবি ম্যান্ডেলা। ম্যান্ডেলার দাদা ছিলেন একজন রাজা এবং বাবা ছিলেন টেম্বু উপজাতির গোত্রপ্রধান। জন্মের ৮ বছর বয়সেই তিনি বাবাকে হারান। পরে তার গোত্র প্রধানের পরিচর্যায় বড় হন। তার শৈশবকাল কাটে নানার বাড়িতে। তিনিই তার পরিবারের প্রথম সদস্য যিনি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। স্কুলে পড়ার সময় তার শিক্ষিকা মদিঙ্গানে তার ইংরেজি নাম রাখেন “নেলসন”।

ম্যান্ডেলার কারাb> ম্যান্ডেলাকে শত শত পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে। গত চার দশকে ম্যান্ডেলা ২৫০টিরও অধিক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি ১৯৮৮ সালে শাখারভ পুরস্কারটি যৌথভাবে অর্জন করেন। ১৯৯৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯০ সালে ভারত সরকার তাকে ভারতরত্ম উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি কানাডার সম্মানজনক নাগরিকত্ব, ব্রিটিশ লেবার পার্টি ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ফুটবল ক্লাবের সম্মানজনক সদস্য হিসেবে সম্মান লাভ করেন। এছাড়া একটি পারমানবিক কনার নাম রাখা হয়েছে ম্যান্ডেলা পার্টিকল। একটি প্রাগৈতিহাসিক কাঠঠোকরা ও একটি অর্কিডের নামকরণও হয়েছে তার নামে। জাতিসংঘ ২০০১ সালে তার জন্ম দিন ১৮ জুলাইকে প্রতিবছর ম্যান্ডেলা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়।

বিদায় বেলা/b> বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার উৎস নেলসন ম্যান্ডেলা। তাঁর অহিংস রাজনীতির আদর্শ ও বর্ণবাদীবিরোধী সংগ্রাম তাকে অনন্তকাল ধরে পৃথিবীবাসীর হৃদয়ে চিরঞ্জীব, চিরস্মরণীয় করে রাখবে। একটি কল্যাণকর ও ন্যায়নিষ্ঠ জাতি গড়ার ক্ষেত্রে তার মূল্যবোধ, ত্যাগ ও সংগ্রাম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

জীবন:
ম্য/ম্যান্ডেলার অন্তিমকাল/মৃত্যু:
রোবেন দ্বীপের নোংরা কারা প্রকোষ্টে থাকার সময় ম্যান্ডেলার শরীরে বাসা বাধে মরণব্যাধি যক্ষ্মা। শেষ বয়সে তাঁর ফুসফুসে সংক্রমণ দেখা দেয়। দীর্ঘ তিন মাস প্রিটোরিয়ার মেডিক্লিনিক হাসপাতালে থাকার পর জোহানেসবার্গের বাড়িতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। ১০ দিন ধরে রাষ্ট্রীয় অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ায় নানা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার পর ১৫ ডিসেম্বর ইস্টার্ন কেপ প্রদেশের নিজ গ্রাম কুনুতে পারিবারিক সমাধিতে তাকে সমাহিত করা হয়।
উপসংহার:<ান্ডেলার কারাবাস শুরু হয় রোবেন দ্বীপে। এখানে তিনি তার ২৭ বছরের কারাবাসের প্রথম ১৮ বছর কাটান। এখানে ম্যান্ডেলা ডি গ্রুপের অর্থাৎ সবচেয়ে কম সুবিধাপ্রাপ্ত বন্দীদের তালিকায় ছিলেন। তাকে মাত্র দুই মিটার চওড়া ও আড়াই মিটার লম্বা একটি প্রকৌষ্টে রাখা হয়েছিল এবং শোয়ার ব্যবস্থা ছিল মেঝেতে। তাকে প্রতি ৬ মাসে একটি মাত্র চিঠি দেয়া হত এবং একজন মাত্র দর্শনার্থীর সাথে দেখা করার অনুমতি দেয়া হত। ম্যান্ডেলাকে লেখা চিঠি কারাগারের সেন্সর কর্মীরা অনেকদিন আটকে রাখত এবং অনেক জায়গায় কালি দিয়ে অপাঠযোগ্য করে দিত। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে ম্যান্ডেলাকে রোবেন দ্বীপের কারাগার থেকে পোল সমুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। পরে ১৯৮৮ সালে তাকে ভিক্টর ভার্সটার কারাগারে নেয়া হয়। মুক্তির আগ পর্যন্ত এ কারাগারেই বন্দী ছিলেন ম্যান্ডেলা।

কারাগার থেকে মুক্তি: ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকার তদানিন্তন রাষ্ট্রপতি পি ডব্লিউ বোথা শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দিতে চাইলে ম্যান্ডেলা তা নাকচ করেছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর মুক্তির জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারের উপর চাপ বাড়তে থাকে। ১৯৮৯ সালে রাষ্ট্রপতি বোথা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পদ থেকে সড়ে দাঁড়ান এবং ফ্রেডেরিক উইলেম ডি ক্লার্ক তার স্থলাভিষিক্ত হন। রাজনৈতিক এই পটপরিবর্তনের পরেই ডি ক্লার্ক ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেয়ার ঘোষণা দেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি: কারামুক্তির পর ম্যান্ডেলা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি এই দলের নেতা ছিলেন। ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতা ক্রিস জানিকে হত্যার ফলে দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে ছিল। তখন ম্যান্ডেলা রাষ্ট্রপতি না থাকা স্বত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি সুলভ ভাষণে দেশবাসীকে শান্তি বজায় রাখার অনুরোধ জানান। এই সময় তিনি সরকারের সাথে বর্ণবাদ অবসানের লক্ষ্যে আলোচনায় বসেন। এই শান্তি আলোচনা ফলপ্রসূ হলে ১৯৯৪ সালে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিকভাবে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ম্যান্ডেলা। তিনি ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।

পুরস্কার ও সম্মান:</

মুজিবনগর সরকার

(সংকেত: ভূমিকা; মুজিবনগর সরকার; মুজিবনগর সরকার গঠনের পটভূমি; আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার গঠন; মুজিবনগর সরকারের কাঠামো; মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ; স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ; মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রম; উপদেষ্টা পরিষদ; স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা; বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতা; উপসংহার।)

ভূমিকা: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক উজ্জ্বল অধ্যায় হলো- মুজিবনগর সরকার। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে গঠন এবং ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেপথ্যে নীতিনির্ধারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় গঠনের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীন কর্ম পরিকল্পনা ও বৈদেশিক সমর্থন আদায়ে এই সরকারের অবদান অনস্বীকার্য। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ সরকারের সকল নীতি নির্ধারণী ব্যক্তিদের জোর তৎপরতার মধ্য দিয়েই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়।

মুজিবনগর সরকার: মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অর্থাৎ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার, মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুজিবনগর সরকারের অবদান অপরিসীম। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলায় মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এই সরকারের প্রধান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামানুসারে এই সরকারের নামকরণ করা হয় মুজিবনগর সরকার। প্রতিষ্ঠাকালীন মুজিবনগর সরকারের সদর দপ্তর মুজিবনগরে স্থাপিত হলেও পরবর্তীকালে এর সদর দপ্তর কলকাতার ৮ নং থিয়েটার রোডে স্থানান্তরিত করা হয়।

মুজিবনগর সরকার গঠনের পটভূমি: ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট সংগটিত হওয়ার সময় যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রেফতার করে তার আগ মুহূর্তে ২৫ মার্চ দিবাগত রাত অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। এরপর ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। মূলত এই দিন হতেই বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের পরিচয় ফুটে উঠে। এদিকে ২৫ মার্চের ভয়াবহ গণহত্যার সময় আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান নেতা তাজউদ্দিন আহমদ নিজ বাসভবন ছেড়ে পালিয়ে যান এবং সরকার গঠনের পরিকল্পনা করেন। এরই মধ্যে ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি ফরিদপুর-কুষ্টিয়া পথে পশ্চিম বাংলার সীমান্তে পৌঁছান। তার সাথে ছিলেন ব্যারিস্টর আমীর-উল-ইসলাম। তারা ৩১ মার্চ মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করলে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মহাপরিদর্শক গোলক মজুমদার যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠকের পূর্বে এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাজউদ্দিন আহমেদকে জিজ্ঞাসা করলেন যে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে কোনো সরকার গঠিত হয়েছে কিনা। সেজন্য বৈঠকে তাজউদ্দিন ইন্দিরা গান্ধীকে বলেন ২৫/২৬ মার্চেই বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়েছে। শেখ মুজিব সেই স্বাধীন সরকারের প্রেসিডেন্ট আর আমি অর্থাৎ (তাজউদ্দিন) প্রধানমন্ত্রী। এভাবেই বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়।

আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার গঠন: ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠক শেষে তিনি বাংলাদেশকে সর্বপ্রকার সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিলে তাজউদ্দিন আহমদ আওয়ামী লীগের M.N.A এবং M.P.A দের কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে অধিবেশন আহ্বান করেন। উক্ত অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী করে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করা হয়। ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে মন্ত্রিপরিষদ গঠনের ঘোষণা দিয়ে ভাষণ প্রদান করেন তাজউদ্দিন আহমদ।

মুজিবনগর সরকারের কাঠামো: ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠন করা হয় মুজিবনগর সরকার। এই সরকার শপথ গ্রহণ করে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। শপথ গ্রহণের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই সরকার। মুজিবনগর সরকারে কাঠামো বা মন্ত্রিসভা নিম্নে দেওয়া হলো।

রাষ্ট্রপতিঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিুর রহমান

উপ-রাষ্ট্রপতিঃ সৈয়দ নজরুল ইসলাম

প্রধানমন্ত্রীঃ তাজউদ্দিন আহমদ

অর্থমন্ত্রীঃ ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী

স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রীঃ এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান

পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রীঃ খন্দকার মোশতাক আহমদ

প্রধান সেনাপতিঃ কর্ণেল (অব.) এম.এ.জি ওসমানী

চিফ অব স্টাফঃ কর্ণেল (অব.) আবদুর রব

ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এবং বিমান বাহিনী প্রধানঃ গ্রুপ ক্যাপেন এ.কে. খন্দকার

[উৎস: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: তৃতীয় খন্ড, পৃ-১৬-১৭]

মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ: মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি ছিল সংক্ষিপ্ত। দেশি-বিদেশি ১২৭ জন সাংবাদিক, কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি বর্গের উপস্থিতির মাধ্যমে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি হয়েছিল। শপথবাক্য পাঠ করান অধ্যাপক ইউসুফ আলী।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ: ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। এই ঘোষণাপত্রটি আগেও ১০ এপ্রিল প্রচার করা হয় এবং এর কার্যকারিতা ঘোষণা করা হয় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উভয়েই ঐ অনুষ্ঠানে বক্তব্য পেশ করেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ তার ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের মাধ্যমে বিশ্বের দেশসমূহের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানান।

উপদেষ্টা পরিষদ: মুজিবনগর সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য লক্ষ্য ছিল দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের সমর্থনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা। এজন্য ন্যাপের মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড মনি সিংহ ও কংগ্রেসের শ্রী মনোরঞ্জন ধরের সমন¦য়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়। যারা মুজিবনগর সরকারকে যুদ্ধকালীন সময়ে দেশ পরিচালনায় সহযোগিতা করতো।

স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিবনগর সরকার নীতি নির্ধারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। এই সরকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সকল ক্ষেত্রেই বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা এবং বহির্বিশ্বের সমর্থন আদায়ের জন্য তৎপরতা চালায়। এছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয় গঠন করে দেশের নিগৃহীত-নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং যুদ্ধকালীন সময়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে। এই সরকারের উপ-রাষ্টপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাত করে বাংলাদেশের সাহায্যের আবেদন জানালে তিনি সম্মত হন।

বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতা: যুদ্ধকালীন সময়ে বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল উল্লেখযোগ্য। তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বিশেষ দূত হিসেবে পাঠানো হয় বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সমর্থন ও জনমত আদায়ের জন্য। এছাড়া বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপান, সুইডেন ও অন্যান্য কতিপয় প্রভাবশালী দেশের সমর্থন লাভের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালানো হয়। তৎকালীন সময়ে কলকাতা, দিল্লি, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক ও স্টকহোমসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মিশন স্থাপন করা ছিল এই সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এই সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এপ্রিল মাস থেকে পাকিস্তান দূতাবাসের অনেক বাঙালি পক্ষত্যাগ করে। মে মাসের প্রথম দিকে শেখ মুজিবুর রহমানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অধ্যাপক রেহমান সোবহান সরকারের নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্রে যান। তার তৎপরতার ফলে বিশ্ব ব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে। এছাড়া ১৯৭১ সালের অক্টোবরে মুজিবনগর সরকারের ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলকে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের জন্য পাঠানো হয়। এই অধিবেশনে উপস্থিত ৪৭টি দেশের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ঘটনা শুনে সহানুভূতি প্রদর্শন করেন। এভাবে মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় বহির্বিশ্বের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট ছিল।

উপসংহার: মুজিবনগর সরকার শুধুমাত্র দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষাই নয় বরং বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনসমর্থন আদায়ের জন্য জোর তৎপরতা চালায়। মুজিবনগর সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণেই বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আর্বিভূত হয়। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সাথে এই সরকারের ভূমিকা ছিল অনন্য। তাই আমাদের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে মুজিবনগর সরকারের নাম।

অলিম্পিক গেমস

(সংকেত: ভূমিকা; অলিম্পিক গেমসের ইতিহাস; গেমসের ছন্দপতন; অলিম্পিকের রকমফের; প্রতীক; খেলাধুলা; অলিম্পিকের পদক; উপসংহার।)

ভূমিকা: প্রাচীন গ্রীসে দেবতাদের বাসভূমি বলে গণ্য অলিম্পাস পাহাড়ের পাদদেশে দেবতাদের সম্মানার্থে যে খেলাধুলার প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হতো তাকে অলিম্পিক গেমস বলা হয়। মনে করা হয় প্রধানত গ্রীসের এলিসের অলিম্পিক ভিলেজে অলিম্পাস পাহাড়ের পাদদেশে দেবতা জিউসের উদ্দেশ্যে ৪ বছর পর পর অলিম্পিক গেমস আয়োজিত হতো। সেই প্রাচীনকাল থেকে আজকের আধুনিক অলিম্পিক, মাঝে পেরিয়ে গেছে অনেকটা সময়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে অলিম্পিকে এসেছে নানা পরিবর্তন। কে প্রচলন করেছিল অলিম্পিক গেমস তা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও অধিকাংশের মত হলো গ্রীক বীর হারকিউলিস বা হেরাক্লিস প্রচলন করেন এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আসরের।

অলিম্পিক গেমসের ইতিহাস: প্রাচীন অলিম্পিকের উৎপত্তি নিয়ে যে জনশ্রুতিগুলো রয়েছে তা খানিকটা ধোঁয়াশাপূর্ণ। বেশকিছু মিথও প্রচলিত আছে এ নিয়ে। এগুলোর মাঝে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত মিথ অনুসারে গ্রিক রাজা হেরাক্লেস এবং তার বাবা জিউস এই গেমসের আদি পুরুষ। প্রাচীন গ্রিসে অলিম্পাস পাহাড়কে পবিত্র মনে করা হতো। ভাবা হতো এ পাহাড়ে দেবতারা বাস করেন। তাই দেবতাদের সম্মানে পাহাড়ের পাদদেশে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। হেরাক্লেসই প্রথম এ গেমসকে অলিম্পিক নামকরণ করেন এবং তিনি জিউসের সম্মানে অলিম্পিক স্টেডিয়ামও নির্মাণ করেছিলেন। খানিকটা মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও প্রাচীন অলিম্পিকের শুরুর সময়কাল নিয়ে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য মত হলো ৭৭৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। ঐ সময়ের গ্রিসের নগর রাষ্ট্র এবং রাজ্যগুলো এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিত। প্রতিযোগিতা চলাকালে অংশগ্রহণকারী রাজ্যগুলো পরস্পর যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে বিরত থাকত। মূলত দৌড়, মুষ্টিযুদ্ধ, কুস্তি এ ধরণের খেলাগুলো সে সময়ের অলিম্পিকে প্রাধান্য পেত। ১২শ বছর গেমস চলার পর রোমান রাজা থিওডোমিয়াম-১৩৯৩ সালে গেমসের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। পৌত্তলিকতার উপর ভিত্তি করে গেমসের উদ্ভাবন এবং এটি মানুষের মধ্যে সহমর্মিতা তৈরিতে সহায়তা করে না এই অজুহাতে গেমস বিলুপ্ত করা হয়। ৫শ বছর পরে ফ্রান্সের অধিপতি ব্যারন পিয়েরে কুবার্তে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) গঠনের মাধ্যমে ১৮৯৬ সালে আধুনিক অলিম্পিকের শুভ সূচনা করেন। যে গ্রিসে অলিম্পিকের যবনিকা ঘটেছিল সেই গ্রিসেই অলিম্পিকের পুনর্জাগরণ হয়। আইওসির অধীনে প্রথম অলিম্পিকের আয়োজক হবার গর্ব নিজের করে নিল গ্রিসের এথেন্স নগরী। প্রথম আসরে অংশ নেয় ১৪টি দেশের মোট ২৪১ জন অ্যাথলেট। প্রতিযোগিতায় মোট ইভেন্টের সংখ্যা ছিল ৪৩টি।

গেমসের ছন্দপতন: শুরু হওয়ার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত চার বছর পরপর অলিম্পিক তার সূচি অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। তবে চলার পথে ছন্দ পতনের ঘটনা ঘটেছে দুইবার। এ পৃথিবী আধুনিক কালে এসে যে দুটি মহাবিপর্যয় পাড়ি দিয়েছে তা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি অলিম্পিক গেমসও। দু’টি বিশ্বযুদ্ধের তান্ডবলীলায় সভ্যতা যখন থমকে দাঁড়িয়ে পথ খুঁজে ফিরেছে অলিম্পিক গেমসও থমকে গিয়েছিল তখন। ১৯১৬ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে অনুষ্ঠিত হতে পারেনি এর ষষ্ঠ আসর। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞে দাঁড়িয়ে ১৯৪০ ও ১৯৪৪ এ যথাক্রমে ১২ ও ১৩তম আসরের আয়োজন সম্ভব হয়নি। ধ্বংসযজ্ঞ পেরিয়ে পৃথিবী যখন গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে তখন অলিম্পিক গেমসও খুঁজে পেয়েছে নিজস্ব ছন্দ।

অলিম্পিকের রকমফের: অলিম্পিক বললে সাধারণভাবে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিককেই বোঝায়। প্রচার প্রচারণার আলোটাও বেশি থাকে এ অলিম্পিককে ঘিরেই। শুরুতে কেবল গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকই প্রচলিত ছিল। কিন্তু সময়ের প্রেক্ষিতে আরও কিছু অলিম্পিক এর প্রচলন ঘটানো হয়েছে। ১৯২৪ সালে এসে প্রথম শীতকালীন অলিম্পক এর আয়োজন করা হয়। এর কারণ অলিম্পক কর্তৃপক্ষ চেয়েছিল তুষার বা বরফের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু ইভেন্টকে অলিম্পিকে সংযোজন করতে। যা গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে সম্ভব ছিল না। এ কারণে ১৯২১ সালে লুজানে কমিটির কংগ্রেসে অলিম্পিকের শীতকালীন ভার্সন চালুর সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৬০ সালে মার্কিন নাগরিক ইউনাইস কেনেডি শ্রাইভার এর প্রচেষ্টায় স্পেশাল অলিম্পিকের যাত্রা শুরু হয়। স্পেশাল অলিম্পিকে অংশ নিয়ে থাকে বুদ্ধি প্রতিবন্ধীরা। অলিম্পিকে সর্বশেষ সংযোজন হলো যুব অলিম্পিক। ২০০১ সারে আইওসির ১১৯তম কংগ্রেসে যুব অলিম্পিক আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়। ২০১০ সালে সিঙ্গাপুরে প্রথম গ্রীষ্মকালীন যুব অলিম্পিক এর আয়োজন করা হয়। যুব অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারীদের বয়স ১৪ বছর থেকে ১৮ বছরের মধ্যে হয়।

প্রতীক: অলিম্পিক প্রতীকে ব্যবহৃত হয় ভিন্ন ভিন্ন রঙের পরস্পর সংযুক্ত পাঁচটি বৃত্ত। সাদা জমিনের ওপর নীল, হলুদ, কালো, সবুজ ও লাল রঙের বৃত্ত দিয়ে তৈরি হয়েছে অলিম্পিক পতাকা। পতাকার পরিকল্পনাকারীও ছিলেন ব্যারন পিয়েরে কুবার্তো। পাঁচ রঙের বৃত্তগুলো যথাক্রমে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, ওশেনিয়া ও আমেরিকা মহাদেশকে বোঝায়। রঙগুলো বেছে নেয়ার কারণ হলো প্রতিটি জাতির পতাকাতেই এ রংগুলোর অন্তত একটির উপস্থিতি আছে। অলিম্পিক পতাকা ১৯১৪ সালে গৃহীত হলেও গেমসে প্রথম উত্তোলন করা হয় ১৯২০ সালে এন্টওয়ার্প (বেলজিয়াম) অলিম্পিকে। অলিম্পিকের আরেকটি অনুষঙ্গ হলো মশাল। গেমসের কয়েক মাস পূর্বে মশাল প্রজ্বলন প্রাচীন গ্রিক রীতিকে মনে করিয়ে দেয়। বিভিন্ন শহর ঘুরে আসার পর উদ্বোধনী দিনে এটির মাধ্যমে স্টেডিয়ামের বৃহৎ মশাল জ্বালানো হয়। ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিকে প্রথম এর প্রচলন করা হয় যদিও ১৯২৮ সাল থেকেই মশালকে অলিম্পিকের প্রতীক হিসেবে ধরা হত। ১৯৬৮ সালে এসে অলিম্পিকে প্রথম মাসকট এর দেখা মেলে। মাসকট সাধারণত স্বাগতিক দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরে।

খেলাধুলা: বর্তমানে প্রচলিত আছে অলিম্পিক গেমসে এমন খেলার সংখ্যা ৩৫। এ খেলাগুলোই ৩০টি বিভাগে প্রায় ৪০০টির মত ইভেন্টে বিভক্ত। গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে খেলার সংখ্যা ২৬টি; শীতকালীন অলিম্পিকে যার সংখ্যা ১৫। অ্যাথলেটিকস, সাঁতার, ফেন্সিং এবং জিমন্যাস্টিক এর চারটি খেলা গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের কোনো আসর থেকে বাদ পড়েনি। অপরদিকে স্কিইং, স্কেটিং, আইস হকি, নর্ডিক কম্বাইন্ড, স্কি জাম্পিং এবং স্পিড স্কেটিং এ খেলাগুলো শীতকালীন অলিম্পিকের প্রতিটি আসরেই থাকে।

অলিম্পিকের পদক: প্রাপ্তির আনন্দ আর না পাবার বেদনা সবই যখন এই পদককে ঘিরে, তখন পদক তো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেই থাকবে। প্রতিটি ইভেন্টের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারী অ্যাথলেট বা দল যথাক্রমে স্বর্ণ, রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক লাভ করে। তিনটি পদক দেয়ার এ ফরম্যাট চালু হয় ১৯০৪ সাল থেকে। ১৯৪৮ সাল থেকে চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থানধারীদের সনদ দেয়ার ব্যবস্থা চালু হয় যেটা ভিক্টরি ডিপ্লোমা হিসেবে পরিচিত। ১৯৮৪ সালে এসে সপ্তম ও অষ্টম স্থানও ভিক্টরি ডিপ্লোমার অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০০৪ সালে অলিম্পিক যেবার তার আঁতুড় ঘর এথেন্সে ফিরে যায় সেবার পদকের সাথে গ্রিসের জাতীয় প্রতীক জলপাই পাতার মালাও দেয়া হয়। প্রাচীনকালে অলিম্পিকের বিজয়ের প্রতীক ধরা হত জলপাইয়ের মালাকে। একজন আইওসি সদস্য বিজয়ীদের পদক পরিয়ে দেবার পর বিজয়ীদের নিজ নিজ দেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। একই সঙ্গে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত দেশের জাতীয় সঙ্গীতও বাজানো হয়।

উপসংহার: প্রাচীন গ্রীসের গুরুত্বপূর্ণ প্রথার অন্যতম হলো অলিম্পিক। প্রাচীন অলিম্পিক গেমসে যতটা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ছিল ততটা ধর্মীয় উৎসবও ছিল। গ্রিক দেবতা জিউসের সম্মানার্থে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হত এবং খেলার মাঝে একদিন জিউসের কাছে ১০০টি ষাঁড় বলি দেওয়া হত। এরপর সভ্যতার পথ পরিক্রমায় অলিম্পিক গেমস এখন পৃথিবীর প্রধান জমকালো খেলার আসরের মধ্যে একটি।

পোলিওমুক্ত বাংলাদেশ

(সংকেত: ভূমিকা; পোলিও কি; পোলিও রোগের কারণ; পোলিও রোগের লক্ষণ; পোলিও রোগের চিকিৎসা; বাংলাদেশে পোলিও রোগের পূর্বকথা; বাংলাদেশে পোলিও টিকাদান কর্মসূচি; পোলিওমুক্ত বাংলাদেশ; পোলিও রোগ ও বর্তমান বিশ্ব; উপসংহার।)

ভূমিকা: পোলিও একটি ভাইরাসজনিত রোগ। বাংলাদেশ পোলিও রোগ নির্মূলের জন্য ১৯৯৫ সাল থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে জাতীয় টিকা দিবস পালন করে আসছে। এই সফলতার ধারাবাহিকতায় ২৭ মার্চ ২০১৪ তারিখে বাংলাদেশকে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ পোলিওমুক্ত দেশ হিসেবে ঘোষণা করেছে। নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি জোরদার ও জাতীয় টিকা দিবস সফলভাবে পালন করার ফলে ২২ নভেম্বর ২০০৬ সালের পর থেকে অদ্যবধি ৭ বছরের অধিক সময় বাংলাদেশ সম্পূর্ণ পোলিওমুক্ত আছে। চলতি বছরের ২৭ মার্চ পোলিওমুক্ত ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেই সফলতার বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেল।

পোলিও কি: পোলিও, পোলিও মাইলেটিস রোগের সচরাচর ব্যবহৃত নাম। এটি এক ধরণের ভাইরাসজনিত রোগ। পোলিও ভাইরাস আন্ত্রিক ভাইরাস দলেরই অর্ন্তগত। কারণ এটি শরীরের অন্ত্রপথেই দেহে প্রবেশ করে থাকে। তিন ধরণের পোলিও ভাইরাস সংক্রমণের ফলে এই রোগ হয়। পোলিও ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির নার্ভস্ সিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যার ফলে এক পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তি প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ফলে দেখা যায় যে, পোলিও আক্রান্ত ব্যক্তি সারাজীবনের জন্য চলাচলের ক্ষমতা হারায়। তবে ৫ বছরের শিশুদের জন্য এই রোগ বেশী ক্ষতিকর।

পোলিও রোগের কারণ: পোলিও রোগের প্রধান কারণ হলো পোলিও ভাইরাস। এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির পোলিও রোগ হয়। দূষিত খাদ্য ও পানির সাথে শরীরে প্রবেশ করার পর এই ভাইরাস রক্তকোষের মধ্যে দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে রক্তে সংক্রমণ ঘটায়। পরবর্তীতে ভাইরাস প্রান্তীয় স্নায়ু নিউরনের উদ্দীপনার পথ ধরে ছড়িয়ে পড়ে মাইয়েলিনসমূহকে ধ্বংস করে ফেলে। এই মাইয়েলিনের মাধ্যমেই স্নেহ পদার্থসমূহ স্নায়ুতন্ত্র আবৃত করে। যাতে করে স্নায়ু উদ্দীপনা সমূহ সহজেই সঞ্চালিত হতে পারে। আর এখান থেকেই মাইয়েলাইটিস কথাটি এসেছে। এর ফলে চিকিৎসা বিজ্ঞানসংক্রান্ত যে পরিণতি পরিলক্ষিত হয় সেটিই হলো শিথিল পক্ষাঘাত বা পোলিও।

পোলিও রোগের লক্ষণ: পোলিও ভাইরাস শরীরে প্রবেশের ৭ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে পোলিও রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। এই রোগের লক্ষণ হলো- বাচ্চাদের সর্দি-কাশির সঙ্গে জ্বর থাকে, মাথা ব্যথা হয়, সারা শরীরে ব্যথা হয়, গলা ব্যথা হতে পারে, বমিবমি ভাব হয়, ঘাড় ও পিঠ শক্ত হয়ে যায়, হাত ও পা অবশ হয়ে যায়, মুখের একপাশ অবশ হয়ে যেতে পারে, মস্তিষ্কের সমস্যা দেখা দিলে ঢোক গিলতে এবং শ্বাস প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। হাত ও পা চিকন হয়ে যায়।

পোলিও রোগের চিকিৎসা: ভাইরাস আক্রান্ত পোলিও রোগটি প্রতিকারযোগ্য নয় এটি প্রতিরোধযোগ্য। পোলিও রোগের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে এবং সম্পূর্ণভাবে বিশ্রাম নিতে হবে

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা:

- জন্মের পর থেকে প্রত্যেক শিশুকে পোলিও টিকা খাওয়াতে হবে।

- গোসল করা, কাপড় ধৌত করা, রান্না করা থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি কাজে বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করতে হবে।

- স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করতে হবে।

- টয়লেট ব্যবহারের পর ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করতে হবে।

- খাওয়ার আগে ও পরে হাত, মুখ ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।

- নোংরা, অপরিষ্কার কাপড় পুকুরে ধোয়া যাবে না।

বাংলাদেশে পোলিও রোগের পূর্ব কথা: বাংলাদেশে ১৯৭০ এবং ৮০’র দশকে পোলিও আক্রান্তের সংখ্যা ছিল অনেক। সেই প্রেক্ষাপটে ১৯৭৯ সাল থেকে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি চালু হয়। নব্বইয়ের দশকে পোলিও নির্মূলে সফলতা আসতে থাকে। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশে প্রতি এক লাখের মধ্যে পাঁচ বছরের নিচের বয়সের শিশুদের মধ্যে পোলিও রোগাক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫২ জন। ১৯৮৬ সালের আগে বাংলাদেশে প্রতি বছর কমপক্ষে সাড়ে এগারো হাজার শিশু পোলিও আক্রান্ত হতো। তবে ১৯৮৮ সালে বৈশ্বিক পোলিও নির্মূল কর্মসূচির আওতায় দেশে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হলে তা দ্রুত সফলতা লাভ করে। এরই ফলশ্রুতিতে ২০০৬ সালে এসে বাংলাদেশ সম্পূর্ণরূপে পোলিওমুক্ত হয়।

বাংলাদেশে পোলিও টিকাদান কর্মসূচি: প্রকৃতপক্ষে লঘুকৃত ভাইরাস সম্বলিত, মুখে খাওয়ানোর টিকা রক্ষণমূলক অনাক্রম্যতা প্রদানে অধিকমাত্রায় কার্যকর হয়েছে। পোলিওমুক্ত বহুদেশের মত বাংলাদেশও ১৯৯৫ সাল থেকে শিশুকে মুখে খাওয়ানোর পোলিও টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে পোলিও নির্মূলকরণ নীতি গ্রহণ করে। এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে প্রতিবছর ১ লক্ষ শিশুকে দুই ফোঁটা মুখে খাওয়ানো টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে জাতীয় টিকা দিবস পালিত হয়ে আসছে।

পোলিওমুক্ত বাংলাদেশ: ২৭ মার্চ ২০০৪ তারিখে “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা” বাংলাদেশকে পোলিওমুক্ত দেশ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। এই সংস্থাটির দিল্লী কার্যালয় থেকে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১টি দেশকে পোলিওমুক্ত দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০৬ সালের ২২ নভেম্বর এদেশে সর্বশেষ পোলিও রোগী পাওয়া যায়। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম মেনে বাংলাদেশকে তখন পোলিওমুক্ত ঘোষণা করা হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এককভাবে কোনো দেশকে পোলিওমুক্ত ঘোষণা না করে সেটি অঞ্চলভিত্তিক করে থাকে। কেননা সীমানা পার হয়েও ভাইরাসের যাতায়াত হতে পারে। ২০১১ সালে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পোলিও রোগীর সন্ধান পাওয়ায় বাংলাদেশকে পোলিওমুক্ত ঘোষণা করা যায়নি। কোনো দেশে পর পর তিন বছর পোলিও রোগীর সন্ধান পাওয়া না গেলে সে দেশকে পোলিওমুক্ত ঘোষণা করা হয়। গত তিন বছর যাবত বাংলাদেশ, ভারতসহ পাশের দেশে পোলিও রোগী না পাওয়ায় এ অঞ্চলকে পোলিওমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

পোলিও রোগ ও বর্তমান বিশ্ব: ১৯১৬ সালে ১ম আমেরিকায় পোলিও রোগ মাহমারি হিসেবে দেখা দেয়। সে সময় পোলিও রোগের কারণে ২৭ হাজারের বেশি মানুষের অঙ্গহানি এবং ৬ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৪৫ সালে রোটারি ইন্টারন্যাশনাল শুরু করে পোলিও প্লাস ক্যাম্পেইন। সে সময় ১২৫ টিরও বেশি দেশে প্রতিদিন ১ হাজারের বেশি শিশু আক্রান্ত হচ্ছিল। ১৯৫৪ সালে ১ম পোলিও ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়। ১৯৯১ সালে আমেরিকায় শেষ পোলিও রোগ শনাক্ত করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে ১৫০টির বেশি দেশকে পোলিওমুক্ত ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালে পশ্চিমা দেশগুলোকে পোলিওমুক্ত ঘোষণা দেওয়া হয। ২০০২ সালে ইউরোপ থেকে পোলিও নির্মূল করা হয়। ২০০৩ সালে মাত্র ৭টি দেশে পোলিও রোগ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ২০০৮ সালে পোলিও আক্রান্ত দেশ হিসেবে আফগানিস্তান, ভারত, নাইজেরিয়া ও পাকিস্তান এই চারটি দেশকে চিহ্নিত করা হয়। পোলিও নির্মূলের হার দাঁড়ায় শতকরা ৯৯.৪ ভাগ। ২০০৬ সালে ভারতে ৬৭৬ জন পোলিও রোগী থাকলেও ২০০৭ সালেই তা কমে হয় ২৮১ জন। ২০০৮ সালে গোটা বিশ্বে মাত্র ১৬৩৩ জন পোলিও রোগী পাওয়া যায়। তবে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও নাইজেরিয়া এখনও পোলিও রোগ রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আশা করছে ২০১৮ সালের মধ্যে এই তিনটি দেশ থেকেও পোলিও নির্মূল করা সম্ভব হবে।

উপসংহার: পোলিও একটি ভয়াবহ ব্যাধি, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য হুমকি স্বরূপ। তবে সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সার্বিক তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ আজ পোলিওমুক্ত। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বিরাট ইতিবাচক দিক।

শহুরে জীবন

(সংকেত: ভূমিকা; শহর কি; শহুরে জীবনের স্বরূপ; শহুরে জীবনে প্রকৃতি; শহুরে জীবনে অবকাশ; শহুরে জীবনে সুবিধা; শহুরে জীবনে অসুবিধা; উপসংহার।)

ভূমিকা: ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে ''God made the Village man made the town'' অর্থাৎ বিধাতা গ্রাম সৃষ্টি করেছে আর মানুষ তৈরি করেছে নগর/শহর। মানুষ আদিম গুহার অন্ধকার থেকে সভ্যতার পথ পরিক্রমায় তৈরি করেছে অগণিত শহর। রাজ্য শাসন, ব্যবসা, শিক্ষাকেন্দ্র এই সকল বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠত প্রাচীন শহুরে জনপদ। বিজ্ঞানের অগ্রগতি, চাকা এবং বিদ্যুতের আবিষ্কার পৃথিবীর মানচিত্রে নগর গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উৎসাহ যুগিয়েছে। রেললাইনের কল্যাণে এক হয়ে গেছে দূর-দূরান্তের বহু শহর। আধুনিকতা আর শিল্পের ছোঁয়ায় শহুরে জীবন পেয়েছে নান্দনিকতা।

শহর কি: সাধারণত শহর বলতে আমরা বুঝি আধুনিক সভ্যতার সকল উপকরণ সমৃদ্ধ লোকালয়কে। যেখানে শিল্প কারখানা থেকে শুরু করে সব ধরণের নাগরিক ব্যবস্থাপনা রয়েছে। শহরের জীবন যাত্রার মান গ্রামীণ জনপদ থেকে অনেক উন্নত। শহর মানেই উচুঁ দালান-কোঠা, পাকা রাস্তা, যানবাহন আর জীবিকার সন্ধানে ছুটে চলা ব্যস্ত মানুষ। সভ্যতার ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই পৃথিবীর প্রাচীন শহর সমুহকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে বহু সভ্যতা। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৬৫০ সালে তুর্কির “গজনিয়াতেপ” ছিল অফিসিয়ালি পৃথিবীর প্রথম প্রতিষ্ঠিত শহর। এছাড়া মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া, ফিলিস্তিনের জেরুজালেম, ইরাকের কিরকুক এবং চীনের সাঙজি প্রদেশের জিয়ান রয়েছে পৃথিবীর প্রাচীনতম শহরের মধ্যে। বর্তমানেও যত শহর পৃথিবীজুড়ে রয়েছে তার সবগুলোই আধুনিক এবং উন্নত সব প্রযুক্তি সংবলিত। শহর মানেই সময়ের সর্বোচ্চ প্রযুক্তি এবং উন্নত জীবন যাপনের প্রাণকেন্দ্র।

শহুরে জীবনের স্বরূপ: অবিরাম ছুটে চলা, সময়ের ব্যস্ত চাকায় জীবনকে পিষে ফেলাই শহুরে জীবনের স্বরূপ। আপন ভূবন গড়ে তোলাকে নিয়েই দিনরাত ব্যস্ত শহরের মানুষ। মানবিক সম্পর্কগুলো শহরের মানচিত্রে জটিল এক সমীকরণ। জীবনের ব্যস্ত গোলক ধাঁধাঁয় পাক খায় মানুষের আবেগ। আর তাই কাউকে দেখা যায় বিলাসী জীবনের ছন্দে আটকে আছে আর কেউবা অযত্নে অবহেলায় মানবেতর জীবন যাপন করছে। শহর যাকে দেয় দু হাত ভরে দেয় আর যাকে দেয় না সে পড়ে থাকে পথের পাশে। শহর যেন অসমতার এক নীরব তটরেখা। এখানে একই আকাশের নিচে কেউ গরীব, কেউ ধনী, কেউ রাজপ্রাসাদে বাস করে আর কেউ ফুটপাতে। রঙিন বিজলী বাতি আর পাকা বাড়ি শহুরে জীবনকে নান্দনিক করে দিলেও কেড়ে নিয়েছে মানুষের আবেগ। শহরের চারদেয়ালে মানুষের জীবন তাই হয়ে গেছে রংহীন আলপনা। ব্যস্ত শহরের দূষিত বাতাসে আটকে পড়া মন তাই ছুটে যেতে চায় দিগন্তের কাছে। সবুজ গ্রামের উপর নীল আকাশ যেখানে ছাদ হয়ে ঝুলে আছে।

শহুরে জীবনে প্রকৃতি: প্রকৃতি মানেই গ্রাম, যেখানে অবারিত মাঠে খোলা হাওয়া দোল খায় পাকা ধানের শীষে। গ্রামীণ জনপদ পেরিয়ে শহরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ালেই মনে হয় প্রকৃতি যেন পিছনে হাটছে। শহরের ব্যস্ততম রাস্তায় বাতাস থমকে যায়। সবুজ মাঠ, অবারিত ফসলের ক্ষেত আর বহতা নদীর বড় অভাব ইট, কাঠের শহরে। ছয় ঋতুর বাংলাদেশ যেন শহরে এসে অর্ধেক হয়ে গেছে। ঋতু বৈচিত্র্য শহরে নেই বললেই চলে। এখানে ঋতুর পালা বদল মানেই বোশেখের তপ্ত রোদে দগ্ধ হওয়া, কিংবা নাগরিক কোলাহল ছাপিয়ে এক পশলা বৃষ্টির শব্দ। শহরে শীত আসে চুপিসারে, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আবার বিদায়ও নেয়। দালানকোঠার আড়ালে হারিয়ে যায় শরতের কাশফুল। হেমন্তের নবান্ন উৎসব এখানে বড্ড বেমানান। ফসলের মাঠ যেখানে নেই সেখানে নবান্ন আসবেই বা কি করে। এই ছুটে চলা যান্ত্রিক জীবনে বাংলার প্রকৃতি, ছয় ঋতুর পালাবদল কোনো কিছুই চোখে পড়ে না। সবার অলক্ষ্যে নগরের কোনো ছোট্ট উদ্যানে ফুটে থাকে বর্ষার কদম ফুল। শহুরে জীবনে প্রকৃতি মানেই সূর্যের উদয়-অস্ত। ব্যস্ত জীবনে এক পশলা বৃষ্টিই সবাইকে প্রকৃতির ছোঁয়া এনে দেয়। শহুরে জীবনে প্রকৃতির উপস্থিতি তাই একদমই টের পাওয়া যায় না।

শহুরে জীবনে অবকাশ: জীবিকার জন্য যেখানে ছুটে বেড়াতে হয় দিন-রাত সেখানে অবকাশ মানে বিলাসিতা। সারা সপ্তাহ কর্মব্যস্ত থাকার পর একদিনের ছুটি জীবনকে যেন উপহাস করে যায়। শহরের বেশিরভাগ মানুষ তাই ছুটির দিনে বিশ্রাম নিতেই বেশি পছন্দ করে। জীবন যেখানে আবদারের ঝুড়ি মেলে রাখে সেখানে ছোট্ট অবসরটুকুও নানা ব্যস্ততায় কেটে যায়। ছুটির দিনে তাই কেউ কেউ ভীর জমায় শপিং মলে। দৈনন্দিন জীবনের টুকিটাকি প্রয়োজন মেটাতে ছুটতে হয় শপিংয়ে। কেউবা পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে যান চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, শিশুপার্ক কিংবা উদ্যানে। সৌখিন খাবারপ্রিয় মানুষ ভিড় জমান পছন্দের রেস্তোরায়। কেউবা চলে যান সিনেমা দেখতে কিংবা শিল্পকলায় নাটক উপভোগ করতে। ছুটির দিনে তারুণ্যের আড্ডায় মুখরিত হয় টি,এস,সি, ব্যস্ত শহরে সন্ধ্যা নেমে আসে। স্বল্প পরিসরের অবকাশ শেষে আবার গন্তব্যে ফিরে যায় মানুষ। শুরু হয় কর্মমুখর, ব্যস্ত শহুরে জীবন।

শহুরে জীবনের সুবিধা: সভ্যতা গড়ে উঠেছিল শহরকেন্দ্রিক হয়ে, আর তাই শহরে সংযোজিত ছিল মানুষের জন্য সর্বোচ্চ সুবিধা। শহরে উন্নত জীবন যাপনের জন্য সব ধরণের সুযোগ সুবিধা রয়েছে। শিক্ষার জন্য রয়েছে নামি দামি সব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। চিকিৎসার জন্য শহরে রয়েছে অগণিত হাসপাতাল, ক্লিনিক যা মানুষকে সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে। প্রচীনকাল থেকেই ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত শহর। গ্রাম থেকে বহু মানুষ এখনো শহরে আসে জীবিকার সন্ধানে। কর্মব্যস্ততার কারণে মানুষ এখানে ছোট ছোট কাজের জন্য অপরের শরণাপন্ন হচ্ছে। ফলে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র। অফিস, আদালত, কলকারখানাগুলো শহরে অবস্থিত হওয়াতে চাকুরির অন্যতম স্থান হিসেবেও বিবেচিত হয় শহর। গ্রামীণ কৃষির বাজার বলা হয় শহরকে। গ্রাম থেকে কৃষকরা ভালো দামের আশায় তাদের পণ্য নিয়ে আসেন শহরে। শহরে রয়েছে বিদ্যুৎ, যা সভ্যতাকে আলোকিত করেছে। দ্রুত যাতায়াতের জন্য রয়েছে মোটরযান, রেলগাড়ি এবং উড়োজাহাজ। পাকা দালানকোঠা, রাস্তাঘাট এবং রঙ-বেরঙের বিজলী বাতি শহুরে জীবনকে করেছে দৃষ্টিনন্দন। শহরের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এখানে হাতের নাগালেই সব কিছু পাওয়া যায়।

শহুরে জীবনে অসুবিধা: নান্দনিক স্থাপত্য, আকাশচুম্বী সব অট্টালিকা শহরকে একদিকে যেমন দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে অপরদিকে করে তুলেছে বিষাদময়। শহরের কলকারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া বাতাসকে করে দিচ্ছে নিশ্বাসের অনুপযোগী, এর বর্জ্য নদীর পানিকে নষ্ট করছে ক্রমান্বয়ে। জনসংখ্যার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহন। ক্রমবর্ধমান গাড়ির কারণে বেড়ে চলছে যানজট আর শব্দদূষণের মাত্রা। সেই সাথে বাড়ছে দুর্ঘটনা এবং দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার। অনিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক ব্যবস্থার কারণে ঘণ্টাব্যাপী আটকে থাকতে হয় রাস্তায়। নিরাপত্তাহীনতা শহুরে জীবনের আরেক বিরূপ দিক। অনবরত ছিনতাই, ডাকাতি এবং খুনের ঘটনা জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলে। মাঝে মাঝে লোডশেডিংয়ে শহরের চিত্র বদলে যায়। ঘুটঘুটে অন্ধকারকে তখন মনে হয় বিভীষিকাময় রাত। কর্মব্যস্ততার আড়ালে মানুষের সাথে সম্পর্কগুলো কেমন যেন ঠুনকো মনে হয়। অনেক সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধা শহুরে জীবনকে যেন বিষিয়ে তুলে। এইসব নেতিবাচক দিকের প্রভাবে শহুরে মানুষের মনের আবেগ, ভালোবাসা, আন্তরিকতা ক্রমেই অনুভূতিহীন হয়ে পড়ছে।

উপসংহার: বিশ্বায়নের এই যুগে বিলীন হচ্ছে গ্রাম আর বাড়ছে শহর। জীবনের তাগিদে মানুষ পাড়ি জমাচ্ছে গ্রাম ছেড়ে শহরে। মানুষের শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা বাড়াচ্ছে শহরের পরিধি। যান্ত্রিকতায় আটকে যাচ্ছে গ্রামীণ জীবনও। শহর যেমন জেগে থাকে নিশিদিন তেমনি শহরের মানুষও জেগে থাকে নিয়ন আলোর শহরে। অফুরন্ত কাজ আর ব্যস্ততা এই নিয়েই শহরের জীবন । যে জীবনে সম্পর্কগুলোও ইট-পাথরের মতো জড় হয়ে গেছে। তবুও জীবনকে গতিময় করতে, সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে শহরে আসতে হয়, হতে হয় শহুরে।